বঙ্গতাজ কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সত্যিই এক অসাধারণ এবং সংগ্রামমুখর অধ্যায়। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ কিউ. এম. এ. কাদেরের ব্যক্তিগত ত্যাগ, দৃঢ় সংকল্প এবং এলাকার মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল এই বিদ্যাপীঠ।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে কাদের সাহেব এবং তাঁর সহকর্মীকে মুসলিম লীগের লোক হিসেবে চিহ্নিত করে কলেজে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি ছয় মাস পর্যন্ত তাঁদের বেতনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তৎকালীন গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মরহুম গাজী মইজুদ্দিন সাহেবের অকুণ্ঠ সমর্থন কাদের সাহেবকে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখায়। তবে, পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল ছিল যে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে বাধ্য হন।
ঠিক এই সময়ে পলাশের মানুষ কাদের সাহেবকে তাদের পাশে এসে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানায়। জামালপুর কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকও পলাশের ছিলেন এবং তাঁরাও তাঁকে সেখানে চান। এমতাবস্থায়, কাদের সাহেব যখন পলাশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছিলেন, তখন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী মরহুম শামসুদ্দীন সাহেবের আকুল আবেদনে তিনি থমকে দাঁড়ান। শামসুদ্দীন সাহেব কাতর স্বরে অনুরোধ করেন যেন কাদের সাহেব তাঁর নিজের গ্রাম খিরাটিতেই একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই আবেগপূর্ণ অনুরোধ কাদের সাহেবের মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে।
খিরাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। সমাজের কিছু মানুষ উপহাস করেছিল, আবার কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। ডাঃ ছানাউল্লাহ মামার পরামর্শে তৎকালীন এম.পি. ও মন্ত্রীদের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঢাকায় ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদের অপ্রত্যাশিত বিরূপতা এবং পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আন্তরিক সহযোগিতা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১২৫ জন ছাত্রকে সাথে নিয়ে গভীর রাতে মন্ত্রীর বাসভবনে হাজির হওয়া এবং তাঁর কাছ থেকে কলেজ প্রতিষ্ঠার মৌখিক সম্মতি ও একটি লিখিত সমর্থন লাভ করা ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। তাজউদ্দীন আহমদ শুধু সম্মতিই দেননি, বরং ছাত্রদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা এবং রাতে থাকার বন্দোবস্তও করে দেন।
কলেজের অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল জমি ও অর্থের। কাদের সাহেব তাঁর নিজের জমি এবং পৈতৃক সম্পত্তির কিছু অংশ কলেজের নামে লিখে দেন। স্থানীয় অনেকেই কাঠ, বাঁশ, টিন দিয়ে সাহায্য করেন। এমনকি অন্যের গাছ কাটার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয় শুধুমাত্র কলেজের স্বার্থে। গ্রামবাসীদের নীরব সমর্থন ছাড়া এত বড় একটি কাঠামো তৈরি করা সম্ভব ছিল না।
তবে, আর্থিক অসঙ্গতি এবং কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে কাদের সাহেবকে একসময় নিজের হাতে গড়া কলেজ ছেড়ে যেতে হয়। ৫০/৬০ হাজার টাকা চুরির অপবাদ তাঁর গায়ে লাগে, যা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পরবর্তীতে ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবের একটি ছোট্ট চিঠি এই ঘটনার প্রতি নীরব প্রতিবাদ জানায়।
দীর্ঘ দশ বছর বিনা বেতনে বা সামান্য বেতনে কলেজ পরিচালনা করা এবং কলেজের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা সত্ত্বেও কাদের সাহেবের ত্যাগকে গ্রামের কিছু মানুষ ভুল বুঝেছিল। তবে, পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে যথাযথ সম্মান জানিয়েছে। ১৯৯৬ সালে খিরাটি স্কুল মাঠে আয়োজিত এক ফুটবল টুর্নামেন্টে প্রধান অতিথি হিসেবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সেখানে কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সহকর্মীরা তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
এইচ.এস.সি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপনও ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। থানা হেডকোয়ার্টার ছাড়া কেন্দ্র দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও, মন্ত্রীর নামে কলেজ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খিরাটিতেই কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হয়। মনোহরদী কেন্দ্রের অসহযোগিতার কারণে প্রথম দিনের পরীক্ষা দেরিতে শুরু হলেও, কাদের সাহেবের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত বঙ্গতাজ কলেজে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়।
কলেজের লাইব্রেরির জন্য ভারত সরকারের দেওয়া বই চট্টগ্রাম থেকে আনা এবং পরবর্তীতে উইপোকার আক্রমণে কিছু বই নষ্ট হওয়ার ঘটনাও কলেজের শুরুর দিকের কষ্টের চিত্র তুলে ধরে।
নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কাদের সাহেব এবং তাঁর সহকর্মীরা বঙ্গতাজ কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিছু অপ্রত্যাশিত শিক্ষক নিয়োগ এবং পরবর্তীতে তাঁদের নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হলেও, কলেজের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি।
অবশেষে, আর্থিক অস্বচ্ছতার মিথ্যা অভিযোগে কাদের সাহেবকে কলেজ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের প্রতি এমন অবিচার তাঁকে ব্যথিত করে। তবে, তিনি পরবর্তীতে আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁর শিক্ষাজীবনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খিরাটি ছেড়ে আসার পরও কাদের সাহেব কলেজের কাজকর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন, অডিট করিয়েছিলেন যাতে কলেজটি টিকে থাকে। নজরুল প্রফেসরসহ আরও অনেকে কলেজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সহযোগিতা করেন।
বঙ্গতাজ কলেজের প্রতিষ্ঠা কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্মগাথা নয়, এটি কিউ. এম. এ. কাদেরের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা এবং একটি অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারের স্বপ্ন পূরণের ইতিহাস। এই কলেজের প্রতিটি ইটের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের ত্যাগ ও ভালোবাসা।